Tepantor

মঙ্গলে ধর্মজীবীদের অমঙ্গল!

১৩ এপ্রিল, ২০২৩ : ৮:৩৪ অপরাহ্ণ ২৮৯

মোস্তাফিজ চৌধুরী: বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ এলেই এদেশের ধর্ম তথা হালাল-হারাম,জান্নাত-জাহান্নাম বেচে খাওয়া ধর্মজীবীদের চুলকানি বেড়ে যায়,তাদের আরামের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বাঙালি সংস্কৃতিকে বিধর্মীদের সংস্কৃতি,হারাম ও শিরকের চর্চা বলে অভিহিত করে মুহুর্মুহু ফতোয়া ও বক্তব্য প্রসব করতে থাকে। বলতে থাকে পহেলা বৈশাখ হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা হারাম, বাঙালি সংস্কৃতি হারাম।

এতে মনে হয় যেন বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ধর্মজীবীদের ধর্ম বেচে খাওয়ার পেশায় অমঙ্গল বয়ে আনছে!

কারণ তারা জানে এদেশের যারা মুসলিম, তারা বাঙালি এবং মুসলমান। বাঙালির যেমন ধর্মীয় জীবন আছে তেমনি ব্যবহারিক তথা স্বতন্ত্র দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থাও আছে। পৃথিবীর প্রতিটি সমৃদ্ধ জাতির বর্ষবরণের ঐতিহ্য আছে। যে আরব সংস্কৃতিকে ধর্মজীবীরা ইসলামের সংস্কৃতি বলে দাবি করে তা মোটেও ইসলামিক সংস্কৃতি নয়। আরব,পার্সিয়ান, তুর্কি প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি বিদ্যমান যেমনটি রয়েছে বাঙালিরও। আর বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতি পালন করলে তারা ধর্মের নামে আরব্য সংস্কৃতি বিক্রি করতে পারবেনা,তাদের পেটে সস্তায় ভাতও জুটবে না।

ধর্মজীবীরা ধর্ম রক্ষা ও হেফাজতের নামে বিক্ষিপ্ত বিভ্রান্ত ঘটনার দ্বারা ও হাদিস দ্বারা ইসলাম ধর্মে এমনসব কেচ্ছা কাহিনি,বিধিনিষেধ প্রচলন করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে কত যে দ্বিধা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছেন তার হিসাব নিকাশ নেই। কারণ এই ধর্মজীবীরা ক্ষমতার পূজারি,শান-শওকতের পূজারি,এলিট শ্রেণির ভাব ধারণকারী, বহু ডিগ্রিধারী মার্জিত ভদ্র শয়তান, উগ্রবাদী, লোক দেখানো এবাদত বন্দেগিকারী,একে অপরের কুৎসা রটনাকারী। তবে তারা এসব স্বীকার করেনা,তাই নানা বাহানায় শিল্প-সাংস্কৃতির সকল উদযাপনে নানা রকম অযুহাত তৈরি করে।

তারা স্বীকার করেনা ধর্ম আত্নশুদ্ধির জন্য, আর সংস্কৃতি আত্নতুষ্টি ও আত্নবিনোদনের জন্য।
সংস্কৃতি বলতে সাধারণত একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জাতিগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থা তথা আহার-খাদ্যাভ্যাস,আচার-অনুষ্ঠান-বিবাহরীতি ও ভোজ,নাচ-গান-বাদ্য-অভিনয়,যানবাহন, বসন-ভূষণ,বিলাস-ব্যসন, জীবন আদর্শ,গার্হস্থ্যজীবন, ভাষা-সাহিত্য-জ্ঞানবিজ্ঞান-শিক্ষাদীক্ষা,পরিবার ও সমাজব্যবস্থা, শিল্পকলা-লোকায়ত সংগীত, চিত্রশৈলী,মৃৎশিল্প,চিত্রকলা, স্থাপত্য শিল্প,গ্রামীণ সংস্কৃতি, ধর্মকর্ম-ধ্যানধারণা,সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদিকে বুঝায়।

বাঙালির বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রায় গান বাজনা হয়,পশুপাখি সহ বিভিন্ন জিনিসের প্রতীমা ও প্রতিকৃতি তৈরি করা হয় তাই এগুলো হারাম বলে গলা ফাটায় ধর্ম ব্যবসায়ী তথা এর পেশাজীবিরা। কিন্তু ইসলাম ধর্মের একমাত্র পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে সুনির্দিষ্ট করে এগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু তারা বিভিন্ন নামে বেনামে হাদিস ও কেতাবের রেফারেন্স দিয়ে সাধারণ মানুষকে এসব ব্যাপারে জিম্মি করে ফেলার চেষ্টা করে।কিন্তু উমাইয়াদের আমলে হাদিস সংগ্রহ শুরু হয়। মহানবির (সাঃ) জাত শত্রুদের শাসনামলে মহানবির মহাবাণীগুলো আমরা পেয়েছি। সুতরাং প্রতিটি হাদিস কুরআন-এর মানদন্ডে বিচার করতে হবে। যদি সাংঘর্ষিক হয় তবে তা সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দিতে হবে, তা সেই হাদিস যতই নির্ভরযোগ্য বলে দাবি করা হোক না কেন। কারণ, কুরআনকে অনুসরণ করবে হাদিস, কিন্তু হাদিসকে কুরআন কখনই অনুসরণ করতে পারে না।

সমগ্র কুরআন শরিফের কোথাও গান-বাদ্যের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় নি। সমগ্র কোরান শরিফে যে দুইটি শব্দকে ভিত্তি করে যারা গানবাদ্য না-জায়েজ করেছেন, সেই শব্দ দুটো হলো লাহওয়াল হাদিস। যা সূরা লোকমানের ছয় নম্বর আয়াতে আছে। আরবি আভিধানিক ভাষায় লাহওয়াল শব্দের অর্থ হল বাজে তথা অসাড় এবং হাদিস শব্দের অর্থ হলো কথা। দুটো মিলে শাব্দিক অর্থ দাঁড়ালো বাজে কথা। এই ‘অসাড় অথবা বাজে কথা’-কেই পুজি করে কেউ গানবাদ্যকে বুঝিয়েছেন, আবার কেউ কবিতাকে বুঝিয়েছেন, আবার কেউ গানবাদ্য এবং কবিতা দুটোর একটিও বোঝায় নি বলে মন্তব্য করেছেন। আবার অনেকে বলেছেন যেহেতু হজরত দাউদ নবি (আ.) গানবাদ্য করতেন এবং তাঁর মধুর সুরে এমনকি পশু-পাখি পর্যন্ত আসতো সেই হেতু ‘লাহওয়াল হাদিস’ বলতে গানবাদ্যকে বুঝানো হয় নি, যেহেতু তিনিও একজন আল্লাহর নবি ছিলেন। অনেকে আবার বলেছেন যে, যেহেতু গানবাদ্যের আরবি ভাষায় প্রতিশব্দ হল ‘গেনা’ সেই কারণে গেনা শব্দটি কুরআনের কোথাও একটি বারের জন্যও উচ্চারিত হয় নি এবং যেহেতু বলা হয় নি সেহেতু লাহওয়াল শব্দটি যার অর্থ অনর্থক-বাজে-অসারের দ্বারা গানবাদ্যকে বোঝানো হয় নি।

ভারতবর্ষে ইসলামের ধারক ও বাহক হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি এবং তার শীর্ষ হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া চিশতির মাজারে সব সময় কাওয়ালি, গজল, নাত ইত্যাদি তাদের সময় থেকেই হয়ে আসছে এবং মাজার শরিফের পাশেই নামাজ পড়ার জন্য মসজিদও আছে। এশার নামাজ শেষে দিল্লিতে অবস্থিত হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া চিশতির মাজারে গানবাদ্য শুরু হয় এখনও।

এমনকি সঙ্গীত, গায়ক-গায়িকা ও নর্তকীর কমতি ছিলনা কথিত মুসলিম শাসনামলে। তখন জামিলা নামের একজন প্রখ্যাত গায়িকা ছিলেন, হেরেম গায়িকা হিসেবে হাবীবা ও সাল্লামার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হিন্দি সাকি সাকি গানের সুর নকল করে বর্তমান ধর্ম ব্যবসায়ী ওয়াজিনদের যে গজল ভাইরাল হয় সেই ‘সাকি’ বলা হতো মুসলিম খলিফাদের দরবারের নর্তকীদের।

ধর্মজীবীরা জানেনা শিল্পকলা, সঙ্গীত,চারুশিল্প প্রভৃতি মানুষের রক্তে,তার ধমনিতে। সুতরাং মানুষ হিসেবে শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিস্তারের ক্ষেত্রে মুসলমান রাজা-বাদশা-খলিফারা ইসলামকে মানবধর্ম হিসেবে জ্ঞান করে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন তাতে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়নি এবং এক্ষেত্রে তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।

শিল্পকলার প্রতি ইসলাম সবসময়ই সহনশীল, কার্পেট, মৃৎশিল্প,বুকবাইন্ডিং,ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদিতে মুসলমান শিল্পীদের অবদান এখনো অম্লান হয়ে রয়েছে। পবিত্র কুরআন পাকে উল্লেখ আছে, হয়রত ইসা (আঃ) একটি মাটির পাখি তৈরি করেছিলেন এবং আল্লাহ তাঁকে তার মধ্যে প্রাণদানের নির্দেশ দিলে, তিনি মাটির পাখিটির প্রাণদান করেন (৫ঃ১১০)। তাছাড়া মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘরের মূর্তি ধ্বংসের সময় একটি স্তম্ভে অঙ্কিত মাতা মেরির কুলে যিশু ছবি ছিল। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এই অঙ্কিত ছবিটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর চাচাতো ভাই ছিলেন, তিনি কুরআন ও বাইবেলের টীকাকার ছিলেন।

এই ধর্মজীবীরা মক্কায় গিয়ে ‘কালো পাথরে চুমু খাওয়া’ আর ‘শয়তান’কে লক্ষ্য করে ঢিল মারার মধ্যে শিরিক দেখেনা। কিংবা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এর অবয়ব তথা কুশপুত্তলিকা নিয়ে তাদের বিক্ষোভ মিছিল করলেও সেই কুশপুত্তলিকা হারাম হয়না কিন্তু রাজাকারদের কুশপুত্তলিকা নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করলেই হারাম ও শিরক হয়ে যায়।
যতদিন সাধারণের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস থাকবে,জান্নাত ও সওয়াব এর লোভ থাকবে,হালাল-হারাম-জান্নাত-জাহান্নাম বিক্রিত হবে ততদিন ধর্মজীবীরা তাদের অসাধু ব্যবসা চালিয়ে যাবে। সুতরাং তাদের থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই মাধ্যম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক বিপ্লব, আর এতেই তাদের কুচিন্তা ও অপকর্মের অমঙ্গল সাধিত হবে।

উল্লেখ্য যে,পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হলো : ওয়ালাহু আস্লামা মান্ ফিস সামাওয়াতে অল্ আরদ্ – অর্থাৎ ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে।’ অন্যস্থানে কুরআন ঘোষণা করছে, ইউসাববেহু লিল্লাহে মা ফিস্ সামাওয়াতে অমা ফিল আরদ্ – অর্থাৎ ‘সমস্ত আকাশ এবং জমিনের যা কিছু আছে সবাই তসবি পাঠ করছে তথা গুণগান – করছে।’

মাদ্রাসায় পাস করা কথিত আলেম,মোহাদ্দেস, মশায়েখ এবং মুফতিরা তাদের ধর্মব্যবসায় আঘাত আসলেই কথায় কথায় যাকে তাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে বসেন। অথচ তারা যে ফতোয়ার বই পড়ে বড় বড় ফতোয়া প্রসব করেন সে বই ফতোয়াই দারুল উলুম ( ৪৪০/১২)-এ সাবধান করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, কাফের ফতোয়া দেবার প্রশ্ন উঠলে দেখতে হবে যে, যদি শতকরা নিরানব্বই ভাগ কাফের বলার অবকাশ থাকে, কিন্তু মাত্র এক ভাগ কাফের না বলার সম্ভাবনা থাকে, তবে অবশ্যই মুফতি এবং কাজি কাফের ফতোয়া দিতে পারবে না। আদ দুররুল মুখতার নামক ফতোয়ার কেতাবের ‘মুর্তাদ’ অধ্যায়ের (৩৯৯/৩) ফতোয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ‘কাফের ফতোয়া দেবার যদি অনেক কারণও থাকে, তবু যদি মাত্র একটি কারণ কাফের না হবার জন্য বাহির করা যায়, তাহলে কোন মতেই মুফতি এবং কাজি কাফের ফতোয়া দিতে পারবেন না।

মহানবীর (সাঃ) প্রিয় সাহাবা এবং আপন চাচাত ভাই হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সুন্দর একটি উপদেশ দিয়ে গেছেন এই বলে যে,’যেখানেই জ্ঞান পাবে তা অর্জন করে নিও, আর ফিকাহ শাস্ত্রের পণ্ডিতদের ঝগড়া এবং সমালোচনা গ্রহণ করতে যেও না। কারণ, এরা
খোঁয়াড়ে বাস করা মানুষরূপী ভেড়ার দল, এরা একে অন্যের উপর চড়াও হয়’।

লেখক: মোস্তাফিজ চৌধুরী
আজীবন শিক্ষার্থী।

Tepantor

তেপান্তরে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।