Tepantor

দেশে বেড়েই চলেছে আত্মহত্যার প্রবনতা, সামাজিক সচেনতা জরুরি 

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ : ৮:০৬ অপরাহ্ণ

 আশরাফুল মামুন: নায়ক রিয়াজের শ্বশুর মহসিন খানের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা  ঝড়ে নেট দূনিয়া এখন সরগরম। আমি তাকে দোষ দিব না। কারন আমি পাপ কে ঘৃনা করি পাপী কে নয়। দোষারোপ করে সমস্যার সমাধান হয় না। মহসিন খানের মৃত্যুর জন্য দায়ী কঠিন বাস্তব ও পারিপার্শ্বিক জীবন ব্যবস্থা এবং প্রকৃতিগত ভাবে নিষ্ঠুর নিয়তি। মহসিন খানের শেষ সমাধান আত্নহত্যা এটা আমরা মানতে রাজি নই বা মানা উচিত নয়। সম্প্রতি কুমিল্লায় ৭০ বছর বয়সী  বৃদ্ধ এডভোকেট নিঃসঙ্গতা দূর করতে ৪০ বতসর এর যুবতি মেয়েকে বিয়ে করে এখন হাসি খুশিতে দিন কাটাচ্ছেন। সাবেক রেল মন্ত্রী শেষ বয়সে একাকীত্ব দূর করতে ৭০ এ এসে বিয়ে করে স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে ভালোই আছেন। আর যদি ভাগ্য সঙ্গ দেয় তাহলে উনার নাতি পুতিও দেখে যেতে পারবেন বলে আশা করি। মহসিন খানের অর্থ সম্পদ সবই ছিল কিন্তু ভালোবাসা ছিলনা। তাই জীবন দিয়ে দিল! এটাই কি সুষ্ঠু সমাধান? তাহলে এর বিকল্প সমাধান কি ছিল?  তার হতাশার কর্মজীবন নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব থেকে তিনি সোশ্যাল ডিস- অর্ডার, এংজাইটি নামক মানসিক রোগে  ভুগছিলেন। পরিবার পরিজন চাইলে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারতো। এরকম বহু নজির ও আছে।  আমাদের দেশে এই চিকিৎসা সুলভে পাওয়া যায় এবং হাতের কাছেই রয়েছে।

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেছেন, এই যে বিষন্নতা  রোগ,এটা এক দুই মাসে হয় না।  এটা দীর্ঘ সময় ধরে বিষন্নতায় ভুগতে ভুগতে চিকিৎসা না নিলে একসময়  ভয়ঙ্কর রুপ ধারন করে এর বিস্ফোরণ ঘটে। মহসিন খান এর বেলায় এর ব্যাতিক্রম হয়নি। তিনি আরো বলেছেন অনেক সময় রোগী নিজেই জানেন না তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তাই তার চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে আশার কথা হলো এই সমস্যা থেকে চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব। কোন নারী বা পুরুষ যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে মানসিক সমস্যায় ভুগছে আর তখনই পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত তাকে যথাযথ চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা। তাহলেই বেচেঁ যাবে অগণিত অসহায় প্রান।

আত্মহত্যা কখনই কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ইতিমধ্যে স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করার অটোমেটিক মেশিনও আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এর বৈধতা কোন দেশই দেয়নি। বৈধতা দেওয়া উচিতও না। এই কঠিন অবসাদ থেকে বেড়িয়ে আসাও অসম্ভব কিছু ছিল না। আমাদের সমাজে খুজলে এরকম অনেক পাওয়া যাবে যে ভালোবাসার কোন কমতি নেই কিন্তু অর্থের অভাব। অনেকে অর্থের জন্যও আত্নহত্যা করে। আবার কারো কারো অর্থ, ভালোবাসা সবই আছে কিন্তু সূখ নেই। সূখের জন্যও আত্নহত্যা করে। জীবন চলার চলার পথে অসমতা থাকবেই।  তাছাড়াও অনেক আত্মহত্যার কারণ জনসমক্ষে আসে না বা এর প্রকৃত কারণ পরিবার, সমাজ, প্রশাসনও জানতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত এর প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে সেই অনুযায়ী সচেতনতা মূলক কার্যকর ব্যাবস্থা  না নেওয়া হয় ততদিন আত্মহত্যার মহামারী নির্মূল হবে না।

 

আমি একজন রিপোর্টার আমার সাংবাদিকতার শুরু হয়  মফস্বল থেকে। এখন সাংবাদিকতা করছি প্রবাসে।  দুর্ভাগ্যবশত শত শত আত্মহত্যার মরদেহ উদ্ধার করার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। কেউ ফাঁসিতে,কেউ বিষ পান করে,কেউ ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে বা অন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তারা এই আত্মহত্যার অপকর্ম টি করার চেষ্টা করে। তবে এ সমস্ত ঘটনার ৭৫ ভাগের কোন সঠিক কারণ জানা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, কুসংস্কার, অসচেতনতা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও প্রচলিত সামাজিক মিথ বা প্রতিবন্ধকতা। খবর পেয়ে যতবারই মরদেহ উদ্ধারে ঘটনাস্থলে গিয়েছি ততবারই চারদিকে একটা কথা বলতে শুনেছি আত্নহত্যা করা ব্যাক্তি পাগল বা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল তাই আত্মহত্যা করেছে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে ঐ ব্যাক্তির আত্মহত্যার আগে কোন পাগলামি বা অস্বাভাবিক আচরণ তারা দেখতে পায়নি। তাহলে পরিবার পরিজন কেন মিথ্যা বলছে? এর কারন খুজতে গিয়ে জানা যায় আসলে পরিবার কখনো চায় না আত্মহত্যার সঠিক কারণটা পাড়া প্রতিবেশী ও সমাজ এবং প্রশাসন জেনে যাক।  যদি সবাই জেনে যায় তাহলে তারা পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন  হবে। এমনকি পুলিশের জেরার মূখে পড়ে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে। আর আত্মহত্যার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশের কাছে জানতে চাইলে তখন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা একটা মূখস্ত বক্তব্য দিয়ে দেয় সেটা হলো,”খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে, লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে, আমরা তদন্ত করে দেখছি এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে জানতে পারবো ঐ ব্যাক্তি কিভাবে মারা গেছেন বা কি কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন “। এর পরে আর সংগত কারণে কখনো  জানা সম্ভব হয় না ময়না তদন্তের রিপোর্ট কখন এসেছে, তাতে কি লেখা রয়েছে অথবা আত্মহত্যার ঘটনায় পুলিশের তদন্তে কি পাওয়া গেছে এবং পুলিশ কি ব্যাবস্থা নিয়েছে। আর এমন ঘটনা খুব কমই পাওয়া যাবে যে যথাযত কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে আত্মহত্যায় জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে। এজন্য অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনার রহস্য আড়ালেই থেকে যায়।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বছরে সারা পৃথিবী জুড়ে ১০ লাখ মানুষ মানসিক কারণে আত্মহত্যা করে।  আর বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করে গড়ে প্রায় ১১ হাজার থেকে ১৫ হাজার পর্যন্ত। এর মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীরা ই বেশী আত্নহত্যা করে। এই সংখ্যা প্রায় ৮৯% । বেসরকারি এক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন আত্মহননে প্রাণ যাচ্ছে ৩৯ জনের। করোনার এই সময়ে আগের বছরের তুলনায় আত্মহত্যা বাড়ে ৪৪ শতাংশ।

 

মহসিন খান জীবন দিয়ে বলে গেল বাস্তব কত কঠিন ও কত নির্মম। আমরা শিক্ষা নেব যেন তার মত এই পরিনতি আর কারো  না হয়।  আমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত মহসিন খান যে ভাবে নির্মমতার মাধ্যমে নিজের জীবন টা কে নিঃশেষ করে দিল একটি বুলেটের আঘাতে এই রকম পরনতি যেন আমাদের কাউকে বরন করতে না হয়। আমরা তার এই ঘটনা থেকে ইতিবাচক শিক্ষা নেব, কোন নেতিবাচক শিক্ষা নয়। আমাদের এখনই পরিবার ও স্বজনদের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া ছাড়া আরো কোন বিকল্প নেই এই আত্মহত্যার মহামারী রোধ করার।

 

লেখকঃ প্রবাসী সাংবাদিক

আশরাফুল মামুন

jisanmamun86@gmail.com

 

 

 

Tepantor

তেপান্তরে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।